আশ্রম
শব্দটির ব্যাপক অর্থ রয়েছে। আগেকার
দিনে নির্দিষ্ট একটি বয়সে পিতা-মাতা সন্তানদের আশ্রমে
পাঠিয়ে দিতেন এবং তারা সেখানে
থেকেই লেখাপড়া শিখত। আশ্রম বলতে সংসার-ত্যাগীদের
আবাসস্থল এবং সাধনা বা
শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্রকেও বোঝাত। কিন্তু এটি যখনই বৃদ্ধাশ্রম
তখন আপনার চোখের সামনে কি ভেসে উঠছে?৷ বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের অশ্রুশিক্ত চোখ ও তাদের
অবর্ণনীয় দীর্ঘশ্বাস।স্যাঁতসেঁতে, আলো-বাতাসহীন ঝুপড়ি
ঘরে চট গায়ে বৃদ্ধদের
পড়ে থাকার দৃশ্য আজ চলচ্চিত্রে পাওয়া
গেলেও বাস্তবে একটু ব্যতিক্রম। নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়ে বাড়িছাড়া নন
আজ শহরের অধিকাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা৷ বরং এসবের থেকেও
আজ শহরের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে প্রবীণ-প্রবীণাদের সংখ্যা বাড়ছে স্রেফ নিজের মতো করে থাকার
প্রবল ইচ্ছে থেকে৷ প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ইন্দোবাংলার
একটি বহুল প্রশংসনীয় ‘দহন'
ছবিতে সুচিত্রা মিত্র অভিনীত চরিত্রটির মধ্যে এ ধারণার একটি
প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
সংসারে অবাঞ্ছিত না হয়েও তিনি
নিজের মতো করে সম্মানের
সাথে স্বাধীনতাবে স্বনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন
বলে বেছে নিয়েছিলেন বৃদ্ধাশ্রম৷
বাস্তবেও এমন সংখ্যাটাই বেশি।
বৃদ্ধাশ্রম মানেই পারিবারিক অশান্তিতে সবাই বাড়ি ছেড়ে
আসেন, ধারণা ভুল। অবহেলায় নয়,
বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণরা আসছেন একাকিত্ব ঘোচাতে।বার্ধক্যের ধারণাটি আজ বেশ পরিচিত
হয়ে উঠেছে, তবে প্রায়ই ভুল
কারণে। প্রথমত, বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সাথে কোনো কলঙ্ক
ও সহমর্মিতা যুক্ত হওয়ার দরকার নেই এবং তাদের
জন্য আমাদের মমত্ববোধেরও প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত
পরিবারের অনেক বাবা-মা
তাদের সন্তানদের দ্বারা অবহেলিত বা ত্যাগ করা
হয় না।
এখন দেশের মানুষের গড়আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১-৭২ বছরে। অনেক
আগেই ভেঙ্গেছে যৌথ পরিবার। এরপর
থেকেই কমতে শুরু করেছে
পরিবারের সদস্য। যদিও আমাদের দেশের
জন্য ছোট পরিবার একান্ত
জরুরি। বর্তমানে ছোট পরিবার হলে
সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়া যায়।
সুশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা অর্জন
সম্ভব হয়। পরিবারে সুপ্রতিষ্ঠিত
চাকুরে সন্তান থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ
বাবা-মাকে দেখার মতো
কেউ থাকে না, কেননা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব শিক্ষিত সন্তানরা
তাদের লক্ষ্যপূরণ ও চাকরি নিয়ে
পরিবারের বাইরে দেশে ও বিদেশে
অবস্থান করায় বৃদ্ধ পিতা-মাতারা সবকিছু থাকার পরও সেবা পায়
না।
বাড়ি আছে, গাড়ি আছে,
টাকা আছে এবং সম্পদও
আছে- কিন্তু বয়স নেই, নেই
শারীরিক শক্তি। কাছের কেউ না থাকায়
কর্মক্ষমতা হারানো প্রবীণরা তাই অনেক কিছু
থাকার পরও দুঃসহ জীবনযাপন
করতে বাধ্য হন। এই ধরনের
নিঃসঙ্গ বাবা-মায়েদের পরিষেবা
দেওয়ার জন্য বৃদ্ধাশ্রম দরকার৷
নিঃসঙ্গ প্রবীণ-প্রবীণাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেছে, গার্ড,
বাড়ির কেয়ারটেকার, পরিচারিকার হাতে নানান রকমের
ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা৷ নিরাপত্তার মতো তাদের প্রয়োজন
সাহচর্যও৷ একা হাতে হোল্ডিং
ট্যাক্স, পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল
পরিশোধ করতে পারছেন না।
তাই এসব ঝুট ঝামেলা
এড়াতে অনেকেই বৃদ্ধাশ্রম বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়৷
যারা বিবাহ করেননি, এক কথায় ব্যাচেলর,
নিঃসন্তান তাদের একটা সময় পর
বিশেষত অবসরের পর বৃদ্ধাশ্রম প্রয়োজন৷
মেয়ে সন্তানকে বিয়ে দিলে বা
ছেলে বিদেশে থাকলে, বৃদ্ধদের সঙ্গ দেওয়ার দরকার
হয়৷ আগের কনসেপ্ট এখন
মিলবে না৷ আগে বৃদ্ধাশ্রমে
রেখে আসা মানেই আমরা
আমাদের মা-বাবাকে ফেলে
রেখে এসেছি-এই ভাবনা ছিল৷
কিন্তু এখন বৃদ্ধাশ্রম একটা
স্ট্যান্ডার্ড হোটেলের মতো৷ পারস্পরিক ভাবের
আদান-প্রদানের জন্য মানসিক শান্তি
বা নিরাপত্তার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে থাকাই
শ্রেয়৷ একটি শিশু যেমন
খেলার সাথী হিসেবে তার
সমবয়সী কাউকে বেছে নেয়, বয়সের
একটি পর্যায়ে বয়স্ক ব্যক্তিরাও শিশুসুলভ আচরণ করে। তার
আশপাশে সমবয়সী সমভাবাপন্ন কাউকে চায় যার সাথে
সে তার এত বছরের
অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান করতে
পারবে। সারা জীবন কর্মব্যস্ততায়
কাটানো মানুষটি নিজের অবসরপ্রাপ্ত অবস্থায় এমন একটি জায়গা
চায় যেখানে সে স্বনির্ভরভাবে হেসেখেলে
বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে
পারবে। সমাজের ওপর অযাচিতভাবে নয়
বরং শেষ বয়সেও সসম্মানে
মাথা উঁচু করে বাঁচতে
পারবে। আর সেজন্য বৃদ্ধাশ্রমই
শ্রেয়।
সন্তানদের দোষী না করে
এই প্রবীণ মানুষের কথা ভাবুন যারা
কাজের চাপে জীবন উপভোগের
সুযোগ না পেয়ে শেষ
বয়সে নিজের মতো করে বাঁচতে
চাচ্ছেন। সন্তানদেরকেও তো আমরা ডে
কেয়ারে রাখি, তার মানে কি
সন্তানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা নেই। তাই সন্তান
দ্বারা অবহেলিত হয়ে বাবা-মায়ের
ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম- আসুন এ চিন্তাধারাটা
বদলে ফেলি। বয়োবৃদ্ধ মানুষকে নিজের মতো করে বাঁচার
সুযোগ করে দেই। গড়ে
তোলা হোক বৃদ্ধ মা-বাবাদের থাকার উপযোগী আধুনিক, উন্নত ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ আবাসন প্রতিষ্ঠান যার নাম হোক
"Retirement Home". তাহলে
যদি "Old Age
Home/Age Care" এর
বিষাদময় ধারণার কোনো পরিবর্তন আসে!
লেখক: সানজিদা
সুলতানা স্বর্ণা; বিএসসি-জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি, এমএসসি,
মাইক্রোবায়োলজি, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার-সিএসডি, অ্যাক্রো মেডিকেল কেয়ার